Thursday, 7 April 2011

বনভন্তে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

বনভন্তে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

১) প্রস্তাবিত রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; অত্র পার্বত্য অঞ্চলের উচ্চ শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে একটি সাধুবাদযোগ্য উদ্যোগ। পৃথিবীতে আমরা দেখে আসছি বিভিন্ন কৃতী মানুষের নামানুসারে প্রতিষ্ঠান নামকরণ করা হয় যাতে শিক্ষার্থীগণ সেই নামের ও স্মৃতির আদর্শে নিজেদের জীবনকে উদ্দীপিত করতে পারে, এতে সমাজের বিভিন্ন স্তর সেই আলোকিত জীবনের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারে; বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের এই পার্বত্য এলাকায় সাধনানন্দ মহাস্থবিরের অবদান নতুন আলোর ভোরের ন্যায়; যা সকলে একবাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য। রাজনীতি বৌদ্ধ ভিক্ষুরা করতে পারে না তবে ধর্মীয় প্রভাবের আলোকে এই দূর্লভ মহাপুরুষ এতদ অঞ্চলে যে শান্তির বাতাবরণ এনেছেন তা এক কথায় চিন্তা করলে ‘চোখে পানি এসে যায়’। ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের প্রতি আকুল আবেদন প্রস্তাবিত রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এর নামখানি বনভন্তে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় করা হোক। এতে এই তিন পার্বত্য অঞ্চলের জনসাধারণের অনেক বঞ্চনার গ্লানি থাকা সত্ত্বেও কিছুটা আশান্বিত হতে পারবে।

২) পালি ভাষা এবং বৌদ্ধ পিঠকীয় সাহিত্য বিস্মৃত হওয়ার সহজ অর্থ হচ্ছে নিজের পরিচয় লুকিয়ে আধুনিক বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যকে আঁধারে খুঁজে বেড়ানোর ন্যায়। কারণ হিসেবে বলতে গেলে অনেক বিষয় আমরা পাই কিন্তু শুধুমাত্র দুইটি ব্যাপার আলোচনা করছি। (ক) যেমনঃ হস্ত(সংস্কৃত) - হত্থ(পালি) - হাত(বাংলা)। বাংলা ভাষার ব্যাকরণবিদ থেকে শুরু করে সাহিত্য রচয়িতাগণ সংস্কৃত ও বাংলার মাঝের হত্থ জাতীয় শব্দগুলোকে প্রাকৃত/অপভ্রংশ বলে অভিহিত করতে চান; কিন্তু পালি ভাষায় রচিত পবিত্র ত্রিপিটক গ্রন্থ আমাদের হাতে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে তা আসলে পালি ভাষা এবং একমাত্রই পালি ভাষা। ভাষার জালে না জড়িয়ে এ বাস্তব সত্যকে উপলব্দির ও স্বীকৃতির সময় এটি। উপর্যুক্ত ধারাবাহিকতাটি বাংলা সচেতন ব্যক্তি হিসেবে আমরা অনেকে জানি কিন্তু এখন কথা হচ্ছে পালিতে এরূপ অনেক শব্দ যেমনি আছে তেমনি চুরাশি হাজার ধর্ম স্কন্ধের আকর এই পালি; একটি ‘স্কন্ধ’ হচ্ছে একটি বাণীসদৃশ। বর্তমান বাংলা ভাষায় শব্দ রয়েছে এক লক্ষ পঁচিশ হাজার। তাহলে দেখুন, এ রস সিঞ্চনে আমরা বর্তমান বাংলাকে আরো কতটুকু সমৃদ্ধ করতে পারি। (খ) আরেকটি বিষয় হচ্ছেঃ আমরা ‘অপচয়’ শব্দটি ব্যবহার করি কিন্তু এর বিপরীত শব্দ হিসেবে ‘আচয়’ শব্দটি পালি ভাষাভিজ্ঞ ছাড়া কেউ জানেও না। পালিতে এরূপ আরো অনেক শব্দ রয়েছে।

৩) লৌকিক গণিতের সাথে বুদ্ধের ধর্ম ও দর্শনের তুলনামূলক লৌকিক কিছু পরিচয়ও আমরা এখানে তুলে ধরছি যা সচেতন বিজ্ঞ পাঠকের বিচার্য।

ক) বুদ্ধ বলেছেন- এ সংসার অনাদি-অনন্ত; গণিতে আছে সংখ্যারেখা; ব্যাপারটি বুঝিয়ে আঁকিঃ

- +

এই হল মোটামুটি একটি সংখ্যারেখা। অনুসন্ধিৎসু ধর্মগ্রন্থপাঠক, - এর ইংরেজী উচ্চারণ হল মাইনাস ইনফিনিটি অর্থাৎ ঋণাত্বক সংখ্যার কোন শেষ নেই, আবার + এর ইংরেজী উচ্চারণ হল প্লাস ইনফিনিটি অর্থাৎ ধনাত্বক সংখ্যার কোন শেষ নেই। সংসার অর্থ জগত; অনাদি মানে এর আদি নেই এবং অনন্ত মানে এর অন্ত নেই। তাহলে দাঁড়াল কি? সংখ্যারও আদি-অন্ত নেই। আরেকটি বিষয়! তা হলো, ০ (শূন্য) এর অর্থ কি? ধর্মগ্রন্থপাঠক, খুব চিন্তা হচ্ছে তাই না? এর অর্থ আরো সহজ আমরা সবাই এক সময় না এক সময় ‘বুদ্ধ’ হব অর্থাৎ আমাদের লোভ, দ্বেষ, মোহাদি যাবতীয় ক্লেশ এক সময় না এক সময় ‘শূন্য’ হয়ে যাবে।

খ) বুদ্ধ বলেছেন- জীবগণ কর্ম ও কর্মফল ভোগী। গণিতে ‘ফাংশন’ বলে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পদ আছে যা সাধারণত y=f(x) আকারে প্রকাশ করা হয়, গণিত দাবী করে সবকিছুই ফাংশন; ফাংশনের বাইরে কিছু নেই যেখানে x হচ্ছে ইংরেজী উচ্চারণে বললে ইনপুট ভ্যালু অর্থাৎ ‘আমি যে মান দেব’, আর y হচ্ছে ইংরেজী উচ্চারণে বললে আউটপুট ভ্যালু অর্থাৎ ‘আমি যে মান দিয়েছি সে অনুযায়ী যে মানটি পাব’। এখন আসা যাক বুদ্ধের ধর্মেঃ কর্মফল = f(কর্ম) অর্থাৎ যে যেই কর্ম করবে সে সেই অনুযায়ী কর্মফল ভোগ করবে।

৪) বুদ্ধ ধর্মে ও বৌদ্ধ ধর্মে নারীদের অবস্থান বিষয়ে আমরা এ পর্যন্ত ভারত ও বাংলাদেশে বাংলায় কিছু গ্রন্থাদি পাই; তৎমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ থেরীগাথা –ভিক্ষু শীলভদ্র (পরিবর্ধিত ও সংশোধিত ২য় সংস্করণ, মহাবোধি সোসাইটি, কলিকাতা, ১৩৫৩); থেরীগাথা –বিজয়চন্দ্র মজুমদার (সাধনা লাইব্রেরী, ঢাকা, ১৯-তারিখ নেই); বৌদ্ধ রমণী –বিমলাচরণ লাহা (কলিকাতা, ১৯২৯); থেরীগাথায় নারীজীবন –ডঃ অলকা তপস্বী (ধর্মাধার বৌদ্ধ গ্রন্থ প্রকাশনী, কলিকাতা, ১৯৯৮)।

পবিত্র ত্রিপিটকের বিভিন্ন গ্রন্থাদিতে বুদ্ধসমকালীন নারীদের নানা দিক (সহজাত স্বভাব, সাংসারিক জীবন, রাষ্টীয় অবস্থান) সুন্দররূপে উঠে এসেছে তবে থেরীগাথা, থেরীগাথা অর্থকথা হচ্ছে এমন দুটি গ্রন্থ যেখানে শুধুমাত্র সাধারণ নারী হতে কিভাবে থেরী হওয়া যায় তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা রয়েছে ফলে জগত জানতে পারে একজন সাধারণ পুরুষ হতে যেমন নির্বাণ লাভ করা তেমনি একজন সাধারণ নারী থেকেও নির্বাণ লাভ করা যায়। জগত আরো জানতে পারেঃ নারীরা কারো বুকের পাজরের হাড় নয়-তারা স্বকীয় কর্মেরই ফল; তারা কুমারী মাতা নয়-তারা দুষিত থেরীও বটে; তারা বিদ্যার দেবী নয়-তারা বিদ্যা ও বিমুক্তির থেরী (তাদের শেখার আর কিছু নেই-সকল শিক্ষা সমাপ্ত হয়েছে); তারা দূর্গতি নাশের জন্য ঘটা করে ভ্রমণে আসে না-তাদের ভ্রমণ রুদ্ধ হয়েছে (তাদের করণীয় আর কিছু নেই-সকল কাজ কৃত্য হয়েছে); তারা বস্তু ধনের দেবী নয়-তারা অবস্তু মনের থেরী; তারা অবরোধবাসিনী নয়-তারা উন্মূক্তচারিনী; তারা রাজপথের নেত্রী নয়-নির্বাণপথের থেরী। এককথায়, তারা মুক্ত, স্বাধীন, নির্বাণলাভী।

উপর্যুক্ত তালিকা থেকে আমরা পালি থেরীগাথার বাংলা অনুবাদের গ্রন্থাদি পাই; তৎমধ্যে শ্রদ্ধেয় শীলভদ্র ভন্তে (উচ্চারণ-ভান্‌তে) কর্তৃক অনুবাদিত গ্রন্থে কিছুটা শক্তিশালী সৃজনশীল ব্যতিক্রম্যতা লক্ষ্য করা যায় কারণ তিনি নিজ উদ্যোগে গাথার সাথে থেরীগণের জীবনীও থেরীগাথা অর্থকথার মূল থেকে অনুবাদ করে প্রকাশ করেন একই থেরীগাথায় ফলে বাংলা ভাষাভাষী বৌদ্ধ দরিদ্র নর-নারীগণ একসাথে জীবনী ও গাথার অমৃত আস্বাদন করতে সমর্থ হন; কিন্তু হয়ত মারাক্তান্ত হয়ে তাতে উৎপল বর্ণা থেরীর জীবনকাহিনী অনেকাংশে মূলের চেয়ে সংক্ষিপ্তাকারে তিনি অনুবাদ করেন। এ পর্যন্ত হলেও- তিনি শুধু ধন্যবাদার্হ্য নন তিনি পূজনীয়। তিনি শুধু থেরীগাথা গ্রন্থেরই অনুবাদক নন তিনি পিঠকীয় দীর্ঘনিকায়সহ বৌদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন গ্রন্থের রচনাকার; ফলে তিনি অতীত নন তিনি পিঠকীয় বাংলা সাহিত্যে চিরজাগরূক। বাংলায় যাদের হাত ধরে পিঠকীয় সাহিত্য আজ অব্দি এসেছে তিনি সেই পুরোধাদের অন্যতম; তাই তিনি প্রাতস্মরণীয়। পরবর্তীতে তাঁরই অনুসৃত ধারাবাহিকতায় আমরা বর্তমানে আরেকটি পালিসহ থেরীগাথা (বাংলাদেশেই কথিত অনুবাদকৃত) পাই। তো যা হোক, বাঞ্ছিতের সন্ধানে (ভিক্ষু শীলভদ্র-মহাবোধি সোসাইটি, কলিকাতা) গেলে কিছুটা অবাঞ্ছিতেরও সন্ধান মিলে বৈ কি!

পরম পূজনীয় বনভন্তে বলেন – সাধারণের নিন্দা-প্রশংসায় কিছু যায় আসে না। সকলকে অসাধারণ করার জন্য তিনি প্রতিনিয়ত ধর্মদান করে যাচ্ছেন। নিতান্ত সাধারণ এই প্রবন্ধকার জীবনের প্রথম এরূপ দূর্লভ আর্যশ্রাবকের জন্ম-বার্ষিকীতে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদনের সুযোগ পেল, এ মম পরম প্রাপ্তি; তাই অসাধারণের গুণকীর্তন করতে গিয়ে কোন সাধারণ যেন বুঝতে না পেরে পাছে রাগ করে ফেলে সে ভয়ও পাচ্ছি। কিন্তু আরেকটি বিষয় না বলে পারছি না তা হলো অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে মহামঙ্গল –আনন্দমিত্র মহাথের (মূল “মঙ্গলদীপনী” লংকাক্ষরে পালি ভাষা হতে অনুদিত) পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে; শ্রদ্ধেয় আনন্দমিত্র ভন্তেও উক্ত গ্রন্থখানিতে শক্তিশালী সৃজনশীল ব্যতিক্রম্যতা ও দক্ষতার সাক্ষর রেখেছেন কিন্তু যাঁরা গ্রন্থখানি পুনঃপ্রকাশ (সংঘরাজ ধর্মানন্দ-ধর্মপ্রিয় একাডেমী) করেছেন সেই গুণোত্তম ভিক্ষুরাও সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য এ কারণে যে তাঁরা পালিসহ মহামঙ্গল নামে নিজ নামে কোন গ্রন্থ বের করেননি কারণ একটাই তাঁরা ভিক্ষু। ভিক্ষুরা ব্রহ্মবিহারী (মৈত্রী-করুণা-মুদিতা-উপেক্ষা)। ‘মুদিতা’ বলতে তাঁরা শুধু শিখেছে ‘মানীর মান দিতে হয়’ এটুকুই; তাহলে স্বভাবতই আতংকিত হতে হয়- এরূপ সংক্রামক নকলের ভাইরাস ছড়িয়ে গেলে তো সমস্যা!

তবে সুআশার কথা হচ্ছে, বর্তমানে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সর্বপ্রথম থেরীগাথা অর্থকথা (অনুবাদক-সম্বোধি ভিক্ষু, রাজবন বিহার, রাঙামাটি) বাংলায় অনুবাদিত হয়েছে। উপর্যুক্ত তালিকার গ্রন্থগুলোতে বুদ্ধ ধর্মে ও বৌদ্ধ ধর্মে নারীদের অবস্থান বিষয়ে আমরা আংশিকরূপে খন্ডে খন্ডে ধারণা পেয়ে এসেছি কিন্তু থেরীগাথা অর্থকথা গ্রন্থখানি থেকে মৌলিক পূর্ণাঙ্গ ধারণা লাভ করা যাবে। সচেতন উপাসক-উপাসিকাগণের থেরীগাথা অর্থকথা গ্রন্থখানি যত বেশী পারা যায় তত পুনঃপ্রকাশ করার জন্য সচেষ্ট হওয়া দরকার যাতে আমাদের দুঃখক্লিষ্ট মা-বোনেরা নিজেদের জীবন সম্পর্কে একটি সঠিক সুন্দর ধারণা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে।

আর্যশ্রাবক বনভন্তেকে শুধু বাংলাদেশে বুদ্ধ-ধর্ম-সংঘ সংস্কার নয় সাথে সাথে বাংলাদেশে বৌদ্ধ সমাজ সংস্কারের মধ্য দিয়েও যেতে হচ্ছে ফলে একজন এরূপ দূর্লভ মহাপুরুষের নিকট হতে আমরা অনেক কিছুই বঞ্চিত হচ্ছি! আমরা বাঙালি বাংলাদেশী বৌদ্ধরা যতদিন এ সত্য উপলব্দি করতে পারব না ততদিন অভাগাই শুধু নয় দুর্ভাগাও হয়ে রইব! পরিশেষে, লোক হিতকামী আর্য পুদগল সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভন্তে) কল্পকাল আমাদের মাঝে সশরীরে বেঁচে থেকে আমাদের একমাত্র পরম লক্ষ্য নির্বাণ পথের সহায়ক হোক – এ প্রার্থনায় এ ক্ষুদ্র শ্রদ্ধার্ঘখানি সমাপ্ত করলাম।

সব্বে সত্তা সুখীতা হোন্ত।

সমগ্‌গানং তপো সুখো।।

জুয়েল বড়ুয়া

ছাত্র, শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

5 comments:

  1. Can you let me know whether any Bengali translation of the book Apadana is vailable in the market?

    ReplyDelete
  2. Hello Jewel!
    Why do you not reply?

    ReplyDelete
  3. still not but it will be published soon

    ReplyDelete
  4. THANKS.

    Please let me know whether Rajana Vihara, Rangamati is publishing the Bengali translation of "Apadana".

    I also like to know whether we can have the Bengali Translation of the Entire Tripitaka with Atthakatha and Tika is going on.

    ReplyDelete
  5. Hello Jewel,
    You even do not reply here. Then why do you open this Weblog (BLOG)?

    ReplyDelete